কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মোখলেস উদ্দিন ভূইয়াকে তার চাচাদের মামলার কাগজপত্র ঠিক করে দেয়ায় তারই বন্ধু মিজানসহ অন্যান্য সহযোগীরা তাকে খুন করে নরসুন্দা নদীতে ফেলে দেয় বলে জানা গেছে তার পারিবারিক সূত্রে।
এদিক মোখলেস নিখোঁজ হবার খবর শুনে গত ১৩ এপ্রিল তার বাবা মকবুল হোসেন ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যান।
এর আগে গত ২৯ মার্চ রাতে তারাবি পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হন ছাত্রলীগ নেতা মোখলেস।
তার পরিবারের সূত্রে জানা যায়,বেশ কিছুদিন আগে তার চাচাদের পরিবারের সাথে অভিযুক্ত মিজানদের পরিবারের ঝগড়া হয়।সেই ঝগড়ার পর তার চাচারা মামলা করেন।নিহত মোখলেস তার চাচাদের জায়গার দলিল পত্র ঠিক করার ব্যাপারে সাহায্য করায় অভিযুক্ত হত্যাকারীরা তাকে সতর্ক করে এসবে না জড়াতে।পরবর্তীতে অভিযুক্ত আসামি মিজান নিহত মোখলেসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেন এবং তার বাসায় আসা যাওয়া করেন মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে।
সেই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী পর্যায়ে গত ২৯ এপ্রিল মোখলেসকে তারাবির নামাজের সময় জেলা শহরের হারুয়া এলাকার ভাড়া বাসা থেকে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করে ও লাশ গুম করার উদ্যেশ্যে বস্তাবন্দী করে নরসুন্দা নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
নিহত মোখলেস এর বড় ভাই মিজানুর রহমান জানান,তাদের পরিবারের সবচেয়ে আদরের ভাই ছিলেন মোখলেস। ৮ ভাইবোনের মধ্যে মোখলেস ছিলো তাদের কলিজার টুকরা।তিনি অভিযুক্ত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাসিঁর দাবী করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়,নিহত মোখলেস ও ঘাতক মিজান ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।শৈশব ও কৈশোরের বেড়ে ওঠা সব একসঙ্গে,একই গ্রামে। সম্প্রতি গ্রামের একটি রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব বাঁধে তাদের দুই পরিবারে।ওই ঘটনার পর তাদের মধ্যে মারামারি হয়েছে একাধিকবার। চারটি মামলাও চলছে তাদের মধ্যে। তারপরও তাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট, নিয়মিত মেলামেশা ছিল তাদের। মারামারিতে মিজান আহত হলে গোপনে তাকে হাসপাতালে দেখতেও গিয়েছিলেন মোখলেছ।
সবশেষ গত ২৯ মার্চ রাতে তারা পাগলা মসজিদে একসঙ্গে তারাবি পড়েন।এক পর্যায়ে সেই পারিবারিক দ্বন্দ্বই কাল হয়ে দাঁড়ালো মোখলেছের জীবনে। ওইদিন রাতেই তাকে গলা কেটে হত্যা করে তারই বন্ধু মিজান।
এদিকে নিহত মোখলেসের বোন সুলতানা রাজিয়া জানান,গত ১লা এপ্রিল সকালে আনুমানিক বেলা ১১ টার দিকে একটা নাম্বার থেকে কল দিয়ে বলা হয়েছে মুখলেস ভূইয়া কে খুঁজে পাওয়া গেছে রক্তাক্ত অবস্থায় কুমিল্লা হসপিটালে। এমন খরব দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়েছে পরবর্তী তে ওই নাম্বারে কল দেওয়া হলে নাম্বার টি বন্ধ পাওয়ার যায়।
এ ঘটনার পর ঘাতক মিজানের বাবা মা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান।তারা গৃহপালিত গরুসহ আরো বেশকিছু সম্পদ বিক্রি করে পালিয়ে যান।
পরবর্তীতে নিহতের ভাই মিজানুর রহমান মামলা দায়ের করলে পুলিশ তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় সিলেটের হবিগঞ্জ এলাকা থেকে সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে আটক করে ঘাতক মিজানকে। গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার তিনি বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন।পরে আদালত তাকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়।
এদিকে মঙ্গলবার বিকালে জেলা শহরের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ সংলগ্ন ওয়াচটাওয়ার এলাকায় নরসুন্দা নদী থেকে হত্যাকাণ্ডের পর বস্তাবন্দী করে নদীতে ফেলে দেয়া মোখলেস উদ্দিন ভূইয়া (২৮)’র লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মরদেহ উদ্ধারের আগে ঘটনাস্থল থেকে নিহতের ব্যবহৃত লুঙ্গি, ভাড়া বাসার চাবি ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত সোমবার ও মঙ্গলবার পুলিশ ও ফায়ারসার্ভিসের ডুবুরি দল এবং স্থানীয় জেলেরা জাল ফেলে নরসুন্দা নদীতে ওয়াচটাওয়ার সংলগ্ন ব্রীজের নিচে নিখোঁজ মোখলেস উদ্দিন ভূইয়ার লাশ খুঁজতে অভিযান পরিচালনা করে।
জানা যায়,নিহত মোখলেস উদ্দিন ভূইয়া (২৮) মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের ফুলপুর গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে। তিনি কেওয়ারজোড় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও কিশোরগঞ্জ কোর্টের আইনজীবী সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। নিহত মোখলেস কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে সম্প্রতি বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। থাকতেন জেলা শহরের হারুয়া বৌবাজার এলাকার ভাড়া বাসায়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়,নিহত মোখলেস উদ্দিন ভূইয়া গত ২৯ মার্চ জেলা শহরের পাগলা মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে গত ৩১ মার্চ কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তাঁর বড় ভাই মিজানুর রহমান। পরে ১৬ এপ্রিল এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৫ জনকে আসামি করে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন তিনি।
ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরে এ ঘটনায় অভিযুক্ত মিজান মিয়াকে আটক করা হয়। আটকের পর ওই ছাত্রলীগ নেতাকে গলা কেটে হত্যার পর নরসুন্দা নদীতে ফেলে দেওয়ার প্রাথমিক তথ্য দেন মিজান।
কিশোরগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা জানান,‘মিজানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আমরা সোমবার থেকে নরসুন্দা নদীতে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করি। মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে নরসুন্দা নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় নিহতের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।’
ওসি আরও জানান, ‘এ ঘটনায় অভিযুক্ত বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে ।
এদিকে মঙ্গলবার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ।এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন,
নিহত মোখলেসকে জবাই করে হত্যার পর লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। তার আগে লাশ পানিতে যেন না ভেসে যায় সেই জন্য তার পেট ফুটো করা হয় এবং বস্তায় ভরে বস্তার সঙ্গে সিমেন্টের ব্লক বেঁধে ফেলা হয়। নিহতের লাশ মঙ্গলবার বিকালে নরসুন্দা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও নিহতের পরিহিত লুঙ্গি ও চাবি,হত্যাকান্ডে ব্যাবহৃত ছুড়ি পাওয়া গেছে। উদ্ধারকৃত মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হবে। এ ঘটনায় একজনকে আটক করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।এ ঘটনার সাথে আরো যারা জড়িত তাদেরকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান পুলিশ সুপার।
Leave a Reply