‘হিমালয় কন্যা’ নেপালের ২২ হাজার ৩৪৯ ফুট উচ্চতার এক অনিন্দ্য সুন্দর ও অন্যতম কঠিন পর্বত হলো ‘আমা দাব্লাম’, যার অর্থ ‘মায়ের গলার হার’। এর দুই দিকের ছড়ানো রিজকে কোন এক মায়ের সন্তানকে আগলে রাখার মতো এবং মধ্যবর্তী গিরিশিরাকে মালার মতো মনে হয় বলে এই নামকরণ করা হয়। এর খাড়া রিজ ও ঢালু দেয়ালের জন্য অনেকেই একে ডাকেন ‘হিমালয়ের ম্যাটাহর্ণ’ নামে। নেপালের খুম্বু এলাকায় অবস্থিত এই পর্বতকে সম্মানের চোখে দেখেন পৃথিবীর বাঘা বাঘা পর্বতারোহীরা এর অনেকাংশে ৭০ থেকে ৯০ ডিগ্রি ঢালু পথ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে। এই পর্বত এতোই সমীহের যে এর ছবি দেখা যায় নেপালের এক রুপির ব্যাংক নোটে।
শনিবার, ২ নভেম্বর নেপালের স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১১টায় এই সমীহ জাগানিয়া পর্বত শিখরে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ালেন কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তান তরুণ পর্বতারোহী তানভীর আহমেদ (শাওন)।
১৩ অক্টোবর অভিযানের জন্য নেপালের পথে দেশ ছাড়েন তানভীর। ১৪ অক্টোবর প্রয়োজনীয় অনুমতি এবং অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পরদিনই পৌঁছে যান রামেছাপ নামক বিমানবন্দরে। কিন্তু বৈরি আবহাওয়াতে সেখান থেকে লুকলার নিয়মিত বিমান না চলাতে সেখানেই দুইদিন আটকে থাকতে হয়। কিন্তু অতোবড় স্বপ্ন চোখে নিয়ে কি বসে থাকা যায়? তাই তানভীর পরদিনই সড়ক পথে যাত্রা করেন বেসক্যাম্পের পথে। কিছুপথ গাড়িতে এবং বাকীপথ হেঁটে তিনি ২৪ অক্টোবর পৌঁছে যান আমা দাব্লাম বেসক্যাম্পে। সেখানে থেকে একবার তিনি ঘুরে আসেন ক্যাম্প-২ থেকে, যা উচ্চতায় স্বল্প অক্সিজেন থাকা আবহাওয়ায় শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। এরপর বেসক্যাম্পে নেমে এসে শুরু হয় উপযুক্ত আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা। অবশেষে এলো সেই কঠিনতম পরীক্ষার মহেন্দ্রক্ষণ। ১ নভেম্বর তিনি উঠে যান ক্যাম্প-২ এ। ২ নভেম্বর মধ্য রাতে শুরু হয় তার চূড়ার পৌঁছার চূড়ান্ত যাত্রা এবং সকালে তিনি এই পর্বত শীর্ষ স্পর্শ করেন। পুরো পথেই তার সাথে ছিলেন পর্বতারোহী বন্ধু ও গাইড বীরে তামাং। অভিযানের অপারেটর স্নোয়ি হরাইজন ট্রেক্স এন্ড এক্সপিডিশন নামক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বোধা রাজ ভান্ডারির সূত্র দিয়ে এই সুখবর নিশ্চিত করেন তানভীরের ক্লাব ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’ এর পক্ষ থেকে অভিযানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ফরহান জামান।
তিনি বলেন, ‘এই নিয়ে আমরা ২য় বার আমা দাব্লামে সফল হলাম। আমরা গর্বিত এবং উচ্ছ্বসিত। তবে তানভীর বেসক্যাম্পে নেমে আসতে দুইদিন সময় লাগবে বলে আমরা ধারণা করছি। তাঁর নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য আমরা সকলের দোয়া প্রার্থী।’ উল্লেখ্য যে হিমালয়ের এই অন্যতম কঠিন চুড়ায় প্রথম বাংলাদেশি সফলতা আসে ২০২২ সালে ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের অন্যতম পর্বতারোহী ডা. বাবর আলীর হাত ধরে। এরপর ২০২৩ সালে নিশাত মজুমদার এবং কাউসার রুপক এবং এবছরই তোফিক তমাল এই পর্বত সামিট করেন। তানভীর ৫ম বাংলাদেশি হিসেবে অর্জন করলেন এই বিরল কীর্তি।
তানভীর আহমেদ কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টির অ্যাডভোকেট তারেক উদ্দিন আহমেদ আবাদ এবং শিরীন আহমেদ শিউলির জ্যেষ্ঠ সন্তান। ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা সন্তানের জনক তানভীর কর্মরত আছেন ভিএফ এশিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র প্ল্যানার হিসেবে। কর্মসূত্রে ঢাকার বাসিন্দা এই পর্বতারোহী ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর বর্তমান কার্যকরী কমিটির অর্থ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। আর দশজন বাংলাদেশের পর্বতারোহীর মতোই তারও পাহাড়ে পথচলার পায়েখড়ি হয় বান্দরবানে। এরপর তিনি ভারতের দেও তিব্বা (৬ হাজার ১ মিটার), রামজাক পর্বত (৬ হাজার ৩০৭ মিটার) এবং নেপালের চুলু ফার-ইস্ট (৬ হাজার ৫৯ মিটার) পর্বত অভিযান করেন। এছাড়াও নিজেকে পর্বতের জন্য তৈরি রাখতে নিয়মিত দূরপাল্লার দৌড়, সাইক্লিং, ট্রেকিং ও হাইকিং করেন তিনি। অভিযানের পর্বতসম খরচ এর বড় একটা অংশ যোগান দিয়ে তানভীরকে স্বপ্নের পথে ধাবিত করেন ব্যাগ, ফ্রিয়েসভা বাংলাদেশ এবং এলিট ট্রাভেলস নামক প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও এই অভিযানে সার্বিক সহযোগিতায় ছিল তারই ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।
ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স ক্লাবের প্রেস রিলিজ থেকে
Leave a Reply