তথ্য গোপন করে জমি খারিজ করায় নামজারি বাতিলের আবেদনপত্র ও আদালত কর্তৃক ফৌজদারি কার্য বিধি ১৪৪ ধারা জারি। এসব নথি পেশ করলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দলিল সম্পাদন করাসহ অফিসের একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ত্রিশাল সাবরেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে। এছাড়াও প্রতি মর্গেজে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা করে নেয়াসহ রয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও সরকারি কর্মকর্তার সম্পদের তথ্য বিবরণীতে আছে পুকুর চুরির ঘটনাও।
জানা যায়, উপজেলার সাখুয়া ইউনিয়নের সাখুয়া গ্রামের আবুল মুনসুর মৃত্যুকালে স্ত্রীসহ তিন ছেলে ও ৭ মেয়ে রেখে যান। আবুল মুনসুরের সমূদয় সম্পত্তির পারিবারিক বন্টননামা দলিল না হওয়ার বিষয়টির তথ্য গোপন করে, তার বড় ছেলে আব্দুর রাজ্জাক পৈতৃক সম্পত্তি হতে দুটি দাগে ২২ শতাংশ জমি স্ত্রী ও মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন, জমা খারিজও হয় তাদের নামে। দলিল গ্রহিতারা অপর দুই ব্যক্তির কাছে সেই জমি বিক্রি করে দিতে চাইলে আবুল মুনসুরের অন্যান্য সন্তানরা বিষয়টি জানতে পারেন।
এরপর অন্যান্য ভাই-বোনদের পক্ষে এছহাক আলী ত্রিশাল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) বরাবর নামজারি বাতিলের আবেদন করেন। ভুমি অফিসে নামজারি জমাখারিজ মোকদ্দমার আপত্তি দায়ের করার শুনানীর তারিখ পড়ে ২৬ সেপ্টেম্বর। ওইদিন আবুল মুনসুরের প্রকৃত ওয়ারিশানগনের সনদ হাতে পেয়ে এবং পারিবারিক বন্টননামা দলিল না হওয়ায় আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন ও মেয়ে শারমিন আক্তার মালার নামে জমা খারিজটি বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া এছহাক আলী আদালতের শরাপন্ন হওয়ায় আদালতের নির্দেশে ওই জমিতে ফৌজদারি কার্য বিধি ১৪৪ ধারা জারি করে ত্রিশাল থানা পুলিশ। এ সংক্রান্ত সমস্ত নথি সাবরেজিস্ট্রার বরাবর পেশ করলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দলিল সম্পাদন হয় বলে অভিযোগ করেন এছহাক আলী।
এবিষয়ে এছহাক আলী জানান, নামজারি বাতিলের আবেদনপত্র ও আদালত কর্তৃক ফৌজদারি কার্য বিধি ১৪৪ ধারা জারির নথি পেশ করে সাবরেজিস্ট্রারকে বিস্তারিত অবগত করি। নালিশী ওই দুই দাগে আমার বড় ভাই পাবেন মাত্র আড়াই শতাংশ জমি। বিষয়টি লিখিতভাবে সাবরেজিস্ট্রারকে অবগত করা হলেও তিনি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তড়িগড়ি করে ২২ শতাংশ জমির দলিল রেজিস্ট্রি সম্পাদন করেন। অপারগতায় অবশেষে দলিল বাতিল করতে আদালতে মামলা করতে হয়েছে। উনার সেচ্ছাচারিতার কারণে চরম হয়রনির শিকার হয়েছে আমাদের পুরো পরিবার।
আবুল মুনসুরের ছোট মেয়ে শেফালী বেগম বলেন, বড়ভাই যদি তার প্রাপ্য অংশ বিক্রি করতেন তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। তিনি তো আমাদের মা সহ সব ভাইবোনদের ঠকাতে এ কাজ করেছেন। সাবরেজিস্ট্রার সবকিছু জেনেও শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে দলিল রেজিসিট্র করেছেন।
ঘুষের বিনিময়ে অমিমাংসীত জমির দলিল সম্পাদনের বিষয়টি সামনে এলে অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ত্রিশাল সাবরেজিস্ট্রার মো. জাহিদুল হকের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের অনেক তথ্য। সাবরেজিস্ট্রার মো. জাহিদুল হক ত্রিশাল সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামকে সাথে নিয়ে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, প্রতি টিপসইয়ে ১০০ টাকা, প্রতি দলিলে ১ হাজার হতে ২ হাজার টাকা, প্রতি দলিলের নকল বাবদ গড়ে দুই হাজার টাকা, সরকারি ফি’র বাইরেও দিতে হয় ৪শ টাকা। প্রতি মর্গেজে (ব্যাংকের বন্ধকী) দলিলে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। এক বছরে কমপে ১০ হাজার দলিল হয়। সেমতে বছরে টিপসই বাবদ ১০ লাখ, নকল বাবদ প্রায় দুই কোটি, সরকারি ফি’র বাইরে অতিরিক্ত ৪০ লাখ টাকা এবং মর্গেজ বাবদ গড়ে ২ কোটি টাকা। সাবরেজিস্ট্রার বেতনের বাইরেই অফিস থেকে ত্রিশাল সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামকে সাথে নিয়ে বছরে পায় ৬ কোটি টাকা সেবা প্রত্যাশীদেরকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে ধারনা কর্মচারীদের। অকারণেই কর্মচারীদেরও সভাপতি রফিকুল ইসলামের সাথে যাদের সম্পর্ক ভালো না সেই সব দলিলদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগও রয়েছে জাহিদুল হকের বিরুদ্ধে। এসব কর্মকান্ডে সাবরেজিষ্ট্রার জাহিদুল হক দলিল লেখক সমিতির সভাপতির ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। জাহিদুল হকের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনায় ময়মনসিংহ দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগিরা।
দুদক ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক তাজুল ইসলাম জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর দেড় মাসের মাথায় কমিটির মাধ্যমে যাচাই বাছাই হয়। অভিযোগ যদি দুদকের আইনে তফছিলভুক্ত অপরাধ হয়, তাহলে আমরা সুপারিশ করি এবং সেটা অনুমোদনের জন্য হেড অফিসে পাঠানো হয়। হেড অফিসের যাচাই বাছাই সেলে আবার যাচাই বাছাই হয়। সব ঠিকঠাক থাকলে তবে তা কমিশনের কাছে যাবে। কমিশনের চুড়ান্ত অনুমোদনের প্রেক্ষিতে প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু হয়।
চলতি বছরের ১১ নভেম্বর সাবরেজিস্ট্রার জাহিদের জমা দেয়া সরকারি কর্মকর্তার সম্পদের তথ্য বিবরণী এসেছে আমাদের হাতে। এতে উল্লেখ রয়েছে, শশুর বাড়ি থেকে স্ত্রীর জন্য পেয়েছেন ৩০ ভরি স্বর্নালঙ্কার, যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, কেননা সাংবাদিকদের দেয়া বক্তব্য অনুযায়ি তার বাড়িতে টিনের ঘর। এছাড়া তিনি তার ব্যবহার করা ৪০ লাখ টাকা মূল্যের প্রাইভেটকারের দাম দেখিয়েছেন মাত্র সাড়ে ১১ লাখ টাকা।
তথ্যবিবরনীতে গোপন করা হয়েছে নিউ ভিশন ইকো সিটিতে ক্রয় করা তার একটি প্লটের বিষয় ও । বি ব্লকের ৩৪ নম্বর প্লটটি ক্রয়ের জন্য গত বছরের (২০২৩ সালের) ২১ ও ২৩ নভেম্বর নিউ ভিশন ইকো সিটিতে টাকা পাঠানোর দুটি মানি রিসিট ও সাংবাদিকরা পেয়েছেন। নিউ ভিশন ইকো সিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তাদের ওখানে সর্বনিন্ম একটি প্লটের মূল্য ৬০ লাখ টাকা। যা রীতিমত পুকুর চুরির মতো ঘটনা।
এছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাবরেজিস্ট্রার মো. জাহিদুল হক তার পূর্বের কর্মস্থল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে সেচ্ছাচারীতা, ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এরমধ্যে আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সরকারি খাস জমি নিবন্ধন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ খাজনা খারিজ ব্যাতিত ভুমি নিবন্ধন, ঘুষ ছাড়া সম্পত্তির দলিল না করা, নিষ্কণ্টক জমির জন্যও আলাদা করে ঘুষ গ্রহন ও সরকারি ফি এর বাইরেও জমির মূল্যের ওপরও থাকতো তার কমিশন। দলিল নিবন্ধনের জন্য সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে নেয়া হতো ১ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। ১০-৫০ শতাংশ সাব-রেজিষ্ট্রার এবং বাকি অংশ অন্যদের মধ্যে বণ্টন হয়ে থাকে। যা নিয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গন অভ্যর্থানে স্বরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও তার দোসর ত্রিশাল সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের সাব রেজিষ্ট্রার ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল হক বহাল তবিয়তে থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে এখনো লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অপর একটি সূত্রে আরো জানা যায়, জাহিদুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম এর অনুসারী ও ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। তিনি মেধায় নয় ছাত্রলীগের নেতা থাকার কারনে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হকের বিশেষ সুপারিশে সাব রেজিস্ট্রার পদে চাকরি লাভ করেন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অফিসের একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে ঘুষের টাকা আদায় করেন। সাবরেজিস্ট্রার বেতন ব্যতীত অফিস থেকে বছরে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা সেবা প্রত্যাশীদেরকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
এসব দুর্নীতির বিষয়ে জেলা রেজিষ্টার পথিক সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান সরকারী যেসব ফি রয়েছে তার বাইরে কোন অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিধান নাই তাই অফিসের কেউ কোন ধরনের অতিরিক্ত টাকা নিতে পারেনা।
এসব বিষয়ে ত্রিশাল সাবরেজিস্ট্রার মো. জাহিদুল হক বলেন, আদালতের পার্মিসন ছাড়া কোন দলিল আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই। তবে কেউ অভিযোগ করলে, দুইপক্ষকে ডেকে একটা সমাধানের চেষ্টা করি। পারিবারিক বন্টননামা বাধ্যতামূলক না, করলে ভালো। অভিযোগকারীকে খারিজ ভাঙার সময় দিয়েছিলাম, সময়মতো উনি খারিজ ভাঙতে পারেননি। আর টাকা-পয়সা নেয়ার অভিযোগ আমাদের ওপর কমন বিষয়। তবে নিউ ভিশন ইকো সিটিতে প্লট ক্রয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
Leave a Reply