কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর ও ভৈরবে দুটি টোব্যাকো কোম্পানিতে অভিযান চালিয়েছে যৌথ বাহিনী। মঙ্গলবার,২৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১১ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন , কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাবের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর দুটি টিম কুলিয়ারচরের হেরিটেজ টোব্যাকো ও ভৈরবের তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোতে অভিযান চালায়। অভিযানে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে প্রতিষ্ঠান দুটিকে প্রায় চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি নকল ব্যান্ডরোল (সিগারেটের প্যাকেটে লাগানো ট্যাক্স স্ট্যাম্প) ও সিগারেট জব্দ করা হয়। এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত এবিষয়ে বিভাগীয় মামলা দায়ের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, কুলিয়ারচর সদরে একটি বাদাম মিল রয়েছে। মিলটি অনেক পুরোনো। মিলটির ভেতরে ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর মিল মালিক মো. রফিকুল ইসলাম আরও কয়েকজনকে নিয়ে হ্যারিটেজ টোব্যাকো কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে পাঁচ ধরনের সিগারেট প্রস্তুত হয়। কোম্পানিটির সীমানাপ্রাচীর লাগোয়া তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান। এ কারণে জনস্বাস্থ্য নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। প্রায়ই তারা বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরে আনতেন, কিন্তু প্রতিকার পেতেন না।
যৌথ বাহিনী সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দুপুর থেকে হ্যারিটেজ টোব্যাকো কোম্পানিতে অভিযান শুরু হয়। অভিযানে নানা অনিয়ম দেখতে পায় যৌথ বাহিনী। বিশেষ করে জাল ব্যান্ডরোল ও ব্যবহার করা ব্যান্ডরোলের সন্ধান পাওয়া যায়। বড় ধরনের পরিবেশগত ত্রুটিও শনাক্ত হয়। বিশেষ করে এখানকার বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়, যা নদীর পানিদূষণ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন কুলিয়ারচর সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার মেজর সাজ্জাদুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সামিউল ইসলাম, রাজস্ব কর্মকর্তা (ভৈরব) তাহমিদ আহম্মেদ, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট নরসিংদী বিভাগের উপকমিশনার সোহেল রানা, কিশোরগঞ্জ জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মতিন। পরে অভিযান পরিদর্শনে আসেন ভৈরব সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার লে. কর্নেল ফারহানা আফরিন।
অভিযান শেষে নকল পণ্য উৎপাদনের অভিযোগে হ্যারিটেজ টোব্যাকো কোম্পানিকে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া ৪৭ হাজার ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল এবং নকল সন্দেহে ১ লাখ ৬০ হাজার শলাকা সিগারেট ও ১১ লাখ ২৫ হাজার স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে ভৈরব উপজেলার শম্ভুপুর এলাকায় অবস্থিত তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো কোম্পানিতে যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে জাল ব্যান্ডরোল পাওয়ায় দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয় বলে জানিয়েছেন ভৈরব উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেদোয়ান আহমেদ।
যৌথ বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটির অবস্থান নীরব ও জনশূন্য এলাকায়। মালিকের নাম লিটন মিয়া। কোম্পানির মালিক নানা কৌশলে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছিলেন। অভিযান চলে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। অভিযানে জাল ব্যান্ডরোল ছাড়াও বিপুল পরিমাণ সিগারেট জব্দ করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন ভৈরব সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার লে. কর্নেল ফারহানা আফরিন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মেজর মো. সানজেদুল ইসলাম, র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও ভৈরব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহীন।
ভারপ্রাপ্ত ইউএনও রেদোয়ান আহমেদ বলেন, কোম্পানিটি জাল ব্যান্ডরোলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এসেছে। অভিযানে বিপুল পরিমাণ সিগারেট ও ব্যান্ডরোল জব্দ করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর এনবিআর পরিচালক (জনসংযোগ) সৈয়দ এ মু’মেন এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, অভিযানে হেরিটেজ টোব্যাকো হতে আসল ও নকল ব্যান্ডরোল মিশ্রিত নিম্নস্তরের এক লাখ ৬০ হাজার শলাকা সিগারেট এবং তারা টোব্যাকো হতে ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৮২০ শলাকা সিগারেট আটক করা হয়। যার পণ্য মূল্য ৭৩ লাখ ৯৯ হাজার ১শ’ টাকা। জড়িত রাজস্ব ৫৬ লাখ ২৩ হাজার ৩১৬ টাকা। উদ্ধার করা সিগারেট ইনভেন্ট্রির মাধ্যমে আসল ও নকল আলাদা করে বিভাগীয় মামলা দায়েরের কাজ চলমান রয়েছে।
এ ছাড়া হেরিটেজ টোব্যাকো থেকে ৪৭ হাজার পিস এবং তারা টোব্যাকো হতে ৫০ হাজার পিস নিম্নস্তরের পুনঃব্যবহৃত স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়। যার পণ্য মূল্য ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জড়িত রাজস্ব ৩৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। পুনঃব্যবহৃত স্ট্যাম্পসমূহের জন্য মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী মূসক ফাঁকির মামলা দায়ের করা হচ্ছে। অন্যদিকে নকল বা জাল সন্দেহে হেরিটেজ টোব্যাকো থেকে উচ্চস্তরের ৬ লাখ ৭৫ হাজার পিস ও অতি উচ্চস্তরের চার লাখ ৫০ হাজার পিস স্ট্যাম্প এবং তারা টোব্যাকো হতে নকল বা জাল সন্দেহে তিন হাজার পিস নিম্নস্তরের স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়। যার পণ্য মূল্য ৩০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। জড়িত রাজস্ব ২৪ কোটি ৯৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা। উক্ত স্ট্যাম্পসমূহ দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড, গাজীপুর থেকে আসল বা নকলের সত্যতা যাচাইপূর্বক ফৌজদারি মামলা দায়েরের কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ, হেরিটেজ টোব্যাকো থেকে জব্দ করা সিগারেট, পুনঃব্যবহৃত স্ট্যাম্প ও জাল বা নকল সন্দেহে জব্দ করা স্ট্যাম্পের পণ্য মূল্য ৩০ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জড়িত রাজস্ব ২৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। তারা টোব্যাকো হতে জব্দ করা সিগারেট, পুনঃব্যবহৃত স্ট্যাম্প ও জাল বা নকল সন্দেহে জব্দ করা স্ট্যাম্পের পণ্য মূল্য ৯৩ লাখ ৯৯ হাজার ১০০ টাকা এবং জড়িত রাজস্ব ৭১ লাখ ৪৩ হাজার ৩১৬ টাকা। জব্দ করা মোট পণ্য মূল্য ৩১ কোটি ৮৫ লাখ ৪৯ হাজার ১০০ টাকা। জড়িত রাজস্ব ২৫ কোটি ৮৯ লাখ ২৭ হাজার ৩১৬ টাকা।
এ বিষয়ে বিভাগীয় মামলা দায়ের কার্যক্রম চলমান আছে বলে জানা গেছে।
Leave a Reply