কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে কর্মরত উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. এনামুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও চাকুরি বিধি অনুযায়ী ৩ বছর পর পর বদলীর নিয়ম থাকলেও একই কর্মস্থলে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে চাকুরি করছেন মো. এনামুল ইসলাম খান। জনমনে প্রশ্ন একই কর্মস্থলে থাকার নেপথ্যে রহস্য কি ? স্বার্থ কিংবা লাভই বা কি তার ? আবার অনেকের প্রশ্ন এনামুল ইসলাম খানের খুঁটির জোর কোথায়? কেননা তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগীরা। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলেও কিসের ক্ষমতায় বহাল তবিয়তে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে একই চেয়ারে প্রায় ১৬ বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করে আসছেন ? এ নিয়ে সন্দেহের তীর এখন উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দিকে।
একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন বহাল থাকার সুবাদে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বদলি ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।
সরকারি চাকরিতে একই স্টেশনে ৩ বছরের অধিক সময় থাকার বিধান না থাকলেও মো. এনামুল ইসলাম খান কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বদলি শাখার কতিপয় অসৎ কর্মকর্তাকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে একই স্টেশন ভৈরবে খুঁটি গেড়ে বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছেন দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর এমন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জেলা পর্যায়ে এনামুল ইসলাম খানের বদলি সংক্রান্ত আলোচনা হলেই সেই কর্মকর্তা তাকে ফোনে জানিয়ে দেন। পরে তিনি বিভিন্ন সুপারিশের মাধ্যমে বদলি ঠেকিয়ে দেন। যার ফলে তার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরসহ জেলা প্রশাসক কিশোরগঞ্জ বরাবর একাধিক লিখিত অভিযোগ করার পরও কোন প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগীরা।
মো. এনামুল ইসলাম খান কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নের খাংগাইল গ্রামের মো. ফাইজুর রহমান খান ও মোছা. খুজিস্তা আক্তার খানমের ছেলে। তিনি গত ২০০৯ সালের ১৩ জুনাই সাঁট মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগদান করেন। পরে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে একই চেয়ারে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর পর্যন্ত বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
ভৈরবের বাসিদা শামীম আলম নামে এক ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. এনামুল ইসলাম খান দীর্ঘ দিন যাবৎ ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে চাকরি করার সুযোগে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নাম ভাঙ্গিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করানোর ভয় দেখিয়ে অবৈধ কয়েল, চানাচুর, বিস্কুট, প্রসাধনী ও তেল ফ্যাক্টরি এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনষ্টিক সেন্টার থেকে মাসোহারা আদায় করে থাকেন। এছাড়া উপজেলা পরিষদের বাসা বাড়ি মেরামতের নামে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে প্রতি অর্থবছরে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন। উপজেলা পরিষদের মালি ও সুইপারের নামে ১৫ হাজার টাকা করে মাসিক বেতন তুলে তাদেরকে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা করে দিয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করছেন তিনি। এসব বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করার পরও কোন প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগীরা। শুধু তাই নয় বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, চাকুরীজিবী ও প্রতিষ্ঠান থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলে আত্মসাৎ করে আসছেন তিনি।
বিভিন্ন অভিযোগের কথা উল্লেখ করে ভৈরব উপজেলা পরিষদের মালী মো. আলী গত ২৯ অক্টোবর বাদী হয়ে উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. এনামুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বতীকালীন সরকার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেন। লিখিত অভিযোগলিপিতে তিনি উল্লেখ করেন, মালী পদে দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ ভৈরব উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন তিনি। এনামুল ইসলাম খান উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে চাকুরী করার সুবাদে বিভিন্ন অনিয়মের সাথে জড়িত হওয়ায় তার নামে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবর একাধিক অভিযোগ করা হয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে এনামুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় এনামুল ইসলাম খান তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে বিনা নোটিশে গত তিন মাস আগে মালী মো. আলীকে চাকুরি থেকে বের করে দেন।
বর্তমানে স্ত্রী সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন মালী মো. আলী। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবী করে মালী পদে তার চাকুরী ফিরে পেতে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করেন।
উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. এনামুল ইসলাম খান সরকারি অফিসের টাকা পয়সা এদিক সেদিক করাসহ নিজ হাতে ভাউচার তৈরী করে টাকা উত্তোলন করার কথা স্বীকার করলেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে কোন ব্যবস্থা নেননি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ। এতেই প্রমাণ হয় যে, এনামুল টাকার জোরে ভৈরবে তার খুঁটির ভীত দিন দিন আরো শক্ত করছেন।
এত অল্প টাকা বেতনে কিশোরগঞ্জ কালেক্টরেট কর্মচারী ক্লাবের বাসায় ভাড়া থেকে প্রতিদিন অফিসে আসা যাওয়া, ছেলে মো. ইয়ামিন খান আদিয়ান (১২) ও মোছা. ফারহানা খানম মুন (৯) কে শহরের নামী দামি স্কুলে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে পড়ানো এবং স্ত্রী শামসুন্নাহারের নামে ও শ্যালক, শ্যালিকার নামে একাধিক স্থানে একাধিক জায়গা সম্পত্তি ক্রয় করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া স্ত্রী একজন গৃহিনী হওয়া সত্ত্বেও তার নামে ইনকাম ট্যাক্স এর ফাইল খুলে ও ব্যাংক ব্যালেন্স করে আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন এনামুল ইসলাম খান।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, তিনি একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি হয়েও কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। যা দুদক কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করলে আরো অজানা বহু তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন অনেকে। তাই দুদকের তদন্ত প্রয়োজন এখন জরুরী হয়ে পড়েছে বলে মনেকরছেন অনেকেই।
এছাড়া সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় এনামুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে দূর্নীতির বিষয় নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলেও প্রশাসনের টনক নড়েনি এখনো। বিষয়টি নিয়ে ভৈরবের সর্ব মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে।
এত কিছুর পরও তাকে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে সরানো হয়নি। এতে করে সেবাগ্রহীতারা বৈরি আচরণের শিকার হচ্ছেন।
বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ সংস্কারের উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। অনেকেই দাবী এনামুল ইসলাম খানেরও সংস্কারের প্রয়োজন। তাকে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে দাখিল করা সকল অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং দুর্নীতিসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব নিয়ে আয়ের উৎস বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
অভিযোগ বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে কর্মরত উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. এনামুল ইসলাম খান এসব অভিযোগের বিষয় এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ইউএনও স্যারের সাথে কথা বলুন। পরে তিনি আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তির হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে কথা বলতে বলেন। আব্দুর রাজ্জাকও এ বিষয়ে ইউএনও স্যারের সাথে কথা বলতে বলেন।
এ ব্যাপারে ভৈরব উপজেলা পরিষদ প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রিদওয়ান আহমেদ রাফির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি এবং ভারপ্রাপ্ত ইউএনও হিসেবে কাজ করছি। অভিযোগের বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি অবগত নই। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এব্যাপারে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি কিছুদিন আগে যোগদান করেছি। এ বিষয়ে কোন অভিযোগ পাইনি। ৩ বছরের অধিক সময় একই কর্মস্থলে থাকলে তাকে (এনামুল) অচিরেই অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে এবং তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply