‘বাবা একটু কাছে আসবা? তুমি দেখতে আমার রুবেলের মতো’

রিফাত ইসলাম, চিফ রিপোর্টার।।

0
114

আমরা ক’জন বন্ধু মিলে খাবার, পোশাক ও চিকিৎসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলাম গাজীপুর কাপাসিয়ার আব্দুল আলী বৃদ্ধাশ্রমে।

উপহার দিতে গিয়ে সেখানে একজন বৃদ্ধা মায়ের আকুতি শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আমাকে দেখেই তিনি  বলে ওঠেন ‘বাবা একটু কাছে আসবা? তুমি আমার রুবেলের মতো দেখতে। আহা, কতদিন আমার ছেলেটাকে দেখি না।’

কাছে যেতেই বৃদ্ধা মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। যেন নিজের ছেলেকেই জড়িয়ে আছেন। আন্টি আপনি এখানে কিভাবে এসেছেন? প্রশ্নটা করতেই তাঁর কান্না আরো বেড়ে যায়। 

এই বৃদ্ধা মায়ের নাম সাথী আক্তার। ৬ মাস হলো বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। তাঁর এক ছেলে রুবেল (ছদ্মনাম) ও এক মেয়ে রিতু (ছদ্মনাম)। রুবেল রাজনৈতিক নেতা। দুই স্ত্রী নিয়ে থাকেন গাজীপুরে।  আর মেয়ে রিতুর স্বামী সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। সাথী আক্তারের স্বামীর অঢেল সম্পত্তি থাকলেও তিনি বঞ্চিত হন তার প্রাপ্য থেকে। সাথী আক্তার তার স্বামী আইয়ুব খানের দ্বিতীয় স্ত্রী। আইয়ুব খানের প্রথম স্ত্রীর ষড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ছোট দুইটি সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন সাথী আক্তার। সম্পত্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আইয়ুব খানের প্রথম স্ত্রী রুবেল ও রিতুকে তার কাছে রেখে দেন। 

এদিকে সাথী আক্তার কোন উপায় না পেয়ে গার্মেন্টস এ চাকরী নেন। এভাবেই কেটে যায় কয়েকটি বছর। তিনি কোনভাবেই তার সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। রুবেল ও রিতুও কোন খবর নেয়নি মায়ের। একদিন রুবেলের সড়ক দুর্ঘটনার খবর পান মা। হাসপাতালে ছুটে যান। ১৫ বছর পর সাথী আক্তার রুবেলের দেখা পান। সেদিন হাসপাতালে রুবেল মায়ের কাছে ক্ষমা চান। রুবেল তার মাকে গার্মেন্টস এর চাকরী ছেড়ে দিতে বলেন। খুব শীঘ্রই তার কাছে মাকে নিয়ে আসবেন বলে আশ্বাসও দেন। সাথী আক্তার তার সন্তানকে ক্ষমা করে দেন। ভাবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। তিনি তার এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কয়েক বছর গার্মেন্টস এ চাকরী করে সাথী আক্তার ৭০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। ছেলে-মেয়ে আসে মাকে দেখতে। মা যায় ছেলে-মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু না। কপালে দু:খ থাকলে যা হয় আরকি! রুবেল নানা বাহানায় তার মায়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করেন। সরল মনে মা তার ছেলেকে টাকা দেন। এক পর্যায়ে মায়ের জমানো ৭০ হাজার টাকা শেষ হয়ে যায়। টাকার সাথে মায়ের প্রতি ভালোবাসাটাও উধাও হয়ে যায়। রুবেলের ফোন বন্ধ।  যোগাযোগ করেও কাজ হচ্ছিলো না। রুবেল মাকে জানিয়ে দেয় তার ঘরে বউ বাচ্চা আছে। এমনিতেই অনেক খরচ।  এর মধ্যে বৃদ্ধা মায়ের ভরণপোষণ সম্ভব না। উপায় না পেয়ে মা চলে যায় মেয়ে রিতুর বাড়িতে। সেখানেও নানান কথা শুনতে হয়ে। রুবেলের মতো রিতুও মাকে ত্চ্ছু তাচ্ছিল্য করতে শুরু করেন। রিতুর বাড়িতে ৪ মাস থাকার পর প্রতিবেশীরা মা কে পরামর্শ দেয় বৃদ্ধাশ্রমে চলে যেতে। মা রিতুকে জানায় বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবে। কথাটা শুনে রিতু সেদিন বলেছিলেন-তোমার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও। আমি কিছু জানি না।  নিজ মেয়ের মুখে কথাটা শুনে মায়ের পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে গিয়েছিলো। একদিকে ছেলের স্বার্থপরতা আরেকদিকে মেয়ের প্রত্যাখ্যান। তাঁর আপন বলতে এখন আর কেউ নেই। অবশেষে বৃদ্ধা মায়ের শেষ আশ্রয় হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে।

বৃদ্ধাশ্রমে আসার ৬ মাস পেরিয়ে  গেলেও তাঁর পরিবারের কেউ আসেনি তাঁকে দেখতে। তার এক চাচাতো ভাই মাঝেমাঝে এসে দেখাশোনা করতো। তবে তিনিও ব্যস্ততায় এখন আর আসেন না। জীবনের শেষ বিকেলে বৃদ্ধা সাথী আক্তারের পাশে পরিবারের কেউ রইলো না। একাই মৃত্যুর দিন গুনছেন। তিনি চান মৃত্যুর পর যাতে তাঁর লাশটা তার সন্তানরা না স্পর্শ করে।  

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনার সন্তানরা আপনাকে এভাবে ঠকিয়েছে, তাদের কী শাস্তি চান?

প্রশ্নটা শেষ না হতেই তিনি দুইহাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে  বলে ওঠেন- ‘না না বাবা। আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। আমি চাই আমার রুবেল, রিতু খুব সুখে থাকুক। আল্লাহ্ তাদের যাতে কোন বিপদ আপদ না দেন।’

আমি আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাথা নিচু করে রইলাম। 

তিনি নানা অসুখে ভুগছেন। তার জরায়ুর অপারেশন হয়েছে। আরো দুটো জরুরী অপারেশন করতে হবে। কিন্তু টাকা কোথায়? বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষেরও সবার কথা চিন্তা করতে হয়। তাই তার অপারেশনটা হচ্ছে না। বৃদ্ধা মা আকুতি জানায় যদি কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তাহলে খুব উপকার হতো।

আব্দুল আলী বৃদ্ধাশ্রমে ১৯ জন বৃদ্ধ বাবা-মা রয়েছেন।  প্রত্যেকের জীবনে পেছনের গল্প করুণ। প্রত্যেকেই বুকে পাহাড় সমান দু:খ, হতাশা নিয়ে বেঁচে আছেন। যেনো মৃত্যুই তাদের জীবনের মুক্তি।

এখানে কারোর মৃত্যু হলেই কেবল বাবা-মায়েদের সংখাটা কমে আসে। কারণ এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন বাবা মাকে তার পরিবার ফেরত নিতে আসেনি।
লেখক: রিফাত ইসলাম, চিফ রিপোর্টার, বিডিচ্যানেলফোর ডটকম

পোষ্ট এর সময় 9 months by Ahmad Farid

নিচে কমেন্ট করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে